অরবিন্দ ঘোষ জীবনী | Sri Aurobindo Ghose Biography

Sri Aurobindo Ghose Biography in Bengali

অরবিন্দ ঘোষ এর জীবনী (Sri Aurobindo Ghose Biography in Bengali): ভারতকে স্বাধীন করতে গুটিকয়েক মানুষ বিদ্রোহে নামেননি  , নেমেছেন হাজারও মানুষ। নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যৎ ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছেন এই অগ্নি বলাকার। দেশ মাতাকে পরাধীনতার শিকল থেকে উদ্ধার করতে কোনো কিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন নতুন সূর্যের দিকে। আর তাদেরই মধ্যে একজন ব্যক্তি হলেন ঋষি অরবিন্দ ঘোষ (Aurobindo Ghose)। তাঁর বর্ণময় জীবন তুলে ধরা হল এই প্রতিবেদনে।

অরবিন্দ ঘোষ এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

জন্ম ১৫ অগস্ট, ১৮৭২
মৃত্যু ৫ ডিসেম্বর, ১৯৫০
পরিচিতি ভারতীয় দার্শনিক, যোগী, কবি ও জাতীয়তাবাদী, সাংবাদিক।
পিতা ও মাতা কৃষ্ণধন ঘোষ ও স্বর্ণলতা দেবী।
দাম্পত্য সঙ্গী মৃণালিনী দেবী।

জন্ম - Birthday of Aurobindo Ghose

অরবিন্দ ঘোষ জন্মগ্রহণ করেন কলকাতায়। 

পিতা ও মাতা - Parents

হুগলি জেলার কোন্নগরের ঘোষ বংশের সন্তান। কৃষ্ণধন ঘোষ ছিলেন তৎকালীন বাংলার রংপুর জেলার সার্জন। আর মা ছিলেন স্বর্ণলতা দেবী। রংপুরে থাকার সময়েই স্বর্ণলতা দেবী সন্তানসম্ভবা হন। কৃষ্ণধনের বন্ধু মনোমোহন ঘোষের থিয়েটার রোডের বাড়িতে স্বর্ণলতাকে নিয়ে আসেন। আর এখানেই জন্ম হয় অরবিন্দের। 

বারীন্দ্রকুমার ঘোষ নিজের মায়ের প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘মায়ের মত উদ্দাম পাগলের সঙ্গে সারা জীবন ঘর করা খুব ধৈর্য্যের ও সহিষ্ণুতার কথা, বাবা তা চেষ্টা করেও পারেননি। তবু সে চেষ্টা কম দিন তিনি করেননি। মা পাগল হতে আরম্ভ হবার পরও তাঁদের চার ছেলে ও এক মেয়ে হয়েছিল। 

বোধহয় আমার জন্মের পর বিলাত থেকে ফিরেই দু’জনে পৃথক হন, মা এসে রোহিণীতে বাস করেন। মাকে বাবা মাসে মাসে আর্থিক সাহায্য করতেন, খুব সম্ভব যে সাহায্যের পরিমাণ ও তাঁর আসা যাওয়া ক্রমশঃ কমে এসেছিল, কারণ রেল লাইনের ধারের সেই সাহেবী বাড়ীর মত খানসামা, বাবুর্চি, আয়া ও আড়ম্বর আর তারিণীবাবুর বাড়িতে ছিল না।

একটা চাকর দিত জল আর মা করতেন রান্না। শেষের দিকে টাকা আসতো দাদাবাবু রাজনারায়ণ বসুর হাতে, কারণ আমরা দেখতাম বাঁকে করে করে লোকে মাস কাবারের বাজার দাদাবাবুর বাড়ী থেকে নিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে যেত। বাবার স্বভাব ছিল বেহিসেবী খরচে, টাকা তাঁর হাতে ভোজবাজীর সৃষ্ট জিনিসের মত দেখতে না দেখতে উড়ে যেত।

দয়ার বশে যে নারীর অধিক অসহায় ও দুর্ব্বল, বন্ধুর জন্যে যে এককথায় সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারে, পরিচিত অপরিচিতের যে মানুষ স্বভাবতঃ পরমাশ্রয়, সে মানুষ অমিতব্যয়ী হলে যা হয় এক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। ছেলে তিনটিকে বিলাতে শিক্ষার জন্যে রেখে এসে বাবা কিছুদিন নিয়মিত টাকা পাঠালেন, তারপর সে দিকেও বিশৃঙ্খলা এল।

এইরকম মানুষ দুনিয়ায় অনেক আছে যারা দুঃস্থের জন্যে দানসত্র খুলে বসে আছে, আর তার নিজের পরমাত্মীয় উপবাসে মরছে।’

শৈশব - Childhood

বাবা যতদিন রংপুরে কর্মরত ছিলেন অর্থাৎ ৫ বছর অরবিন্দ রংপুরে জীবন কাটিয়েছেন। 

শিক্ষাজীবন ও জীবনকাহিনী - Education and Career

১৮৭৭ সালে তাঁকে এবং দুই ভাই মনমোহন ঘোষ এবং বিনয়ভূষণ ঘোষকে দার্জিলিংয়ের লোরেট কনভেন্টে পাঠানো হয়। এরপর চলে যান লন্ডনে। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন ছেলে সাহেব হয়ে উঠুক। ১৮৮৪ সালে লন্ডনের সেন্ট পলস স্কুলে ভর্তি হন। তাঁর দুই ভাইও এই স্কুলে ভর্তি হন।

গ্রীক, লাতিন এবং শেষ তিন বছরে সাহিত্য বিশেষত ইংরেজি কবিতায় জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর বাবা ভেবেছিলেন তিনজনই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবেন। কিন্তু তা আর হলনা। বাবার ইচ্ছা পূরণ করতে পারতেন একজনই তা হলেন অরবিন্দ। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ছিল ইংরেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই বছর অধ্যয়নের।

আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তা আর সম্ভবপর হয়নি। কিন্তু কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে অধ্যয়ন করে বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করায় তা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন ২৫০ প্রতিযোগীর মাঝে ১১তম স্থান অধিকার করে। 

কিন্তু তাঁর ইচ্ছা ছিলনা ব্রিটিশদের সেবা করার। আর তাই লিখিত পরীক্ষার পর আর কোনো পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। এরপর বরোদার মহারাজের সাথে বিলেতে তাঁর আলাপ হয়। অন্যদিকে বাবারও পরিচিত ছিল। অর সেই সুবাদেই বারোদা স্টেস সার্ভিসে চাকরির ব্যবস্থা হয়।

বিলেত ছেড়ে ১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের দিকে যাত্রা করেন। ভারতে অপেক্ষা করছিলেন পিতা। কিন্তু ভুল সংবাদ পান। অরবিন্দর জাহাজ ডুবি ঘটেছে। আর সেই শোক সামলাতে না পেরে অরবিন্দর পিতার মৃত্যু ঘটে।

অরবিন্দ বরোদায় এসে সার্ভিস এন্ড সেটলমেন্ট বিভাগে কর্মরত ছিলেন।  পরে সচিবালয়ে গায়কোয়াড়ের জন্য বক্তৃতা লেখার কাজে যোগ দেন। এরপর তিনি বরোদা কলেজে ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। এই কলেজেরই তিনি ভাইস প্রিন্সিপাল হন এখানেই নিজ ঊদ্যোগে সংস্কৃত, হিন্দি এবং বাংলা ভাষায় অধ্যয়ন করেন।

সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কাছে বাংলা শেখেন। তিনি বরোদা থেকেই সাহিত্য রচনা করেন। আর এখানেই লেখেন প্রথম কাব্য সঙ্কলন "The Rishi"। আর এই সময়েই তিনি ব্রিটিশ বিরোধী  সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান করেন। এই সময়েই তাঁর সাথে আলাপ হয়  লোকমান্য তিলক, ভগিনী নিবেদিতা এবং বাঘা যতীনের সাথে।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯০৭ সালে 'বন্দেমাতরম' পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯০৮ সালে মানিকতলায় বোমা কারখানায় ধরা পড়েন, ২ মে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বেশ কয়েকবছর মামলা চলে। বিখ্যাত ব্যারিস্টার তথা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহকারীতায় তিনি খালাস হন। ১৯১০ সালে ফেব্রুয়ারি ৩৮ বছর বয়সে কলকাতা ত্যাগ করে পন্ডিচেরীতে যোগ দেন। সেখানেই জীবনের ৪০ টা বছর কাটান। 

বিবাহ - Married Life

১৯০১ সালে, ২৮ বছর বয়সে মৃণালিনীকে বিয়ে করেন। কলিকাতার শিয়ালদহের সন্নিকটে বৈঠকখানা রোডে বিবাহ আসর  বসে। সারা বাড়ি দেবদারু পাতা দিয়ে সাজানো। সুচারু আল্পনা, তোরণের দুই পাশে জলপূর্ণ মঙ্গল ঘট, কলাগাছ দিয়ে সাজানো। কিন্তু বিয়ের কিছু বছরের মধ্যে ১৯১৮ সালে ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে মারা যান। 

মৃত্যু - Death of Aurobindo Ghose

১৯৫০ এর ৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে মারা যান। পাঁচ  দিন পর পণ্ডিচেরী আশ্রমের এক গাছতলায় সমাধিস্থ করা হয়। 

বিখ্যাত বই - Popular Books

দ্য লাইফ ডিভাইন', 'সাবিত্রী', 'মাদার ইন্ডিয়া', 'এসেজ অন গীতা',  'ভারতের নবজন্ম', 'কারাকাহিনী'।

বিখ্যাত উক্তি - Aurobindo Ghose Quotes

১) ভারত  যদি পাশ্চাত্য সভ্যতার ভালো দিকগুলি গ্রহণ করে  এবং নিজের ক্ষমতা ধ্বংস হতে না দেয়, তাহলে এর সংমিশ্রণে এখানে যে সংস্কৃতি বেরিয়ে আসবে তা সমগ্র বিশ্বের জন্য উপকারী হবে। সেই সংস্কৃতি হয়ে উঠবে বিশ্বের পরবর্তী সংস্কৃতি।

২) দেশ নদী,মাঠ, জমি, পর্বত, বনের মতো বস্তুগত কোনও বিষয় নয়। আমি আমার দেশকে মাতৃজ্ঞানে আরাধনা করি।

৩) পড়াশোনা কর, লেখ, এগিয়ে যাও, কাজ করো, একমাত্র মাতৃভূমির জন্য, মায়ের সেবার জন্য।

৪) শান্তিই প্রথম শর্ত, যা ছাড়া কোনও কিছুই স্থিতিশীল হতে পারে না।

৫) কোনও দেশ বা জাতিই এখন বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে পারে না। 

উল্লেখযোগ্য তথ্য - Facts about Aurobindo Ghose

১) বিলেতে থাকাকালীন তিনি নিজের নাম লিখতেন Aaravind। বরোদায় থাকাকালীন লিখতেন Arvind। বাংলায় আসার পর লিখতেন Aurobindo। এছাড়াও পারিবারিক পদবী Ghose হলেও, তিনি লিখতেন Ghosh।। 

২) অরবিন্দর বাবা ছিলেন  সেই সময়ের প্রখ্যাত চিকিৎসক। তিনি বেশি পরিচিত ডা. কে ডি ঘোষ নামে। 

৩) অরবিন্দর বাবা ছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা রাজনারায়ণ বসু। 

৪) বাবা চেয়েছিলেন ছেলে সাহেব হোক, আর তাই তিনি ছেলের মধ্য নাম রেখেছিলেন ইংরেজি নামে। তাঁর নাম রেখেছিলেন অরবিন্দ 'অ্যাক্রয়েড' ঘোষ। 

৫) বেঙ্গল ন্যাশনাল কলেজ বা জাতীয় বিদ্যালয় ও বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (বর্তমানে যেটি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) এর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন। 

৬) কারাগারে থাকার সময় তিনি আধ্যাত্মিকতায় মগ্ন হন। যখন জেল থেকে বেড়ালেন তখন যেন আলাদা মানুষ। স্বাধীনতা সংগ্রাম ছেড়ে খুঁজতে থাকেন জীবনের অন্য মার্গ। আর তখনই বিপ্লবী অরবিন্দ পরিণত হলেন ঋষি অরবিন্দতে। 

৭) বিবাহের পর বেশ জাকজমকপূর্ণ ভাবে জামাই আদর হয়। তাঁর পছন্দের সবজি ছিল ফুলকপি। জামাইয়ের জন্য পাঁচ-দশ সেরের রুই মাছের মাথা, ফুলকপি, কড়াইশুঁটি, গাজর, বীট, ঘি মাখন ইত্যাদি আসত। 

৮) অরবিন্দর প্রিয় সংগীত ছিল "আমার পরান যাহা চায়"। "তুমি সুখ যদি চাও যাও সুখের সন্ধানে যাও/ আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয় মাঝারে/ আর কিছু নাহি চাহি গো|"

৯) কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত বিশেষ পছন্দ করতেন অরবিন্দ। বিপ্লবী সুধীনকুমারের থেকে জানা যায়, ‘প্রিন্সিপাল পদে ন্যাশনাল কলেজের প্রাপ্য ৭৫ টাকার মধ্যে বাড়ি ভাড়া ২৩ টাকা বাদে আমাদের চার-পাঁচজনের ভরণপোষণ তাঁকে করিতে হয়। একদিন তো বলিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত পড়িতে। তখন তার মূল্য ১৮ টাকা। ভাবিলাম,  উনি তো খাওয়া-পরার হিসাব না করিয়াই বই খরিদ করিতে বলিলেন। আর একেবারে অত বড় বই পড়িবার ধৈর্যও আমার ছিল না। বইয়ের দোকানে গিয়া ছোটখাট মহাভারত পাইলাম সাড়ে সাত টাকায়। উহা কিনিয়া আনিয়া উপর উপর পড়িয়া লইলাম। কয়েকদিন পর আবার মহাভারতের কথা উঠিলে বইখানা ধীরে সন্তর্পণে হাতে দিতেই আমার মুখের দিকে একবার তাকাইয়া ছোট্ট হাসির সাথে বলিলেন, এ মহাভারত পড়িয়া তো লাভ নাই। ইহা আধুনিক ইতিহাসযোগ্য করিয়া লেখা। এসব উপরের খোলস। Spirit বাদ দিয়া খোলস পড়িলে যা হয়, তাই। ফেরত দিয়া বদলাইয়া অন্ততঃ কালীপ্রসন্ন সিংহের বাংলাখানা আনিতে বলিলেন।’

১০) অরবিন্দের পোশাকে নেই বিলেতি ছাপ। জানা যায়, ‘মূল্যবান জুতা, জামা, টাই, কলার, ফ্লানেল লিনেন, পঞ্চাশ রকম আকারের কোট, হ্যাট, ক্যাপ এ সকল তাঁহার কিছুই ছিল না। কোনও দিন তাঁহাকে হ্যাট ব্যবহার করিতে দেখি নাই। যে টুপীগুলি এ দেশে পিরালী টুপী নামে সাধারণত পরিচিত, তিনি তাহাই ব্যবহার করিতেন।’

অরবিন্দ ঘোষ জীবনী (প্রশ্নোত্তর) - Aurobindo Ghose Biography (FAQ)

অরবিন্দের জন্ম কবে?

১৫ অগস্ট, ১৮৭২

অরবিন্দের মৃত্যু কবে?

৫ ডিসেম্বর, ১৯৫০

অরবিন্দ ঘোষের পিতা ও মাতার নাম কী?

কৃষ্ণধন ঘোষ ও স্বর্ণলতা দেবী।

... ...

শেষকথা

অসংখ্য ধন্যবাদ BongHood.Com এর মাধ্যমে অরবিন্দ ঘোষ এর জীবনী (Sri Aurobindo Ghose Biography in Bengali) টি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য। আরও নিত্যনতুন ও জানা অজানা তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইট টি ভিজিট করবেন এবং আমাদের সাথে থাকবেন। আমরা আমাদের সাইটে পোস্ট গুলি নিয়মিত আপডেট করি। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url