আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনী - Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali

Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনী (Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali): উনবিংশ শতাব্দীতে বাংলায় যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিল, সেই  শুভ লগ্নে যিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর নাম জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose)। ইনিই প্রমাণ করেছিলেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। শুধুই কি উদ্ভিদের প্রাণ নিয়ে গবেষণা করে গেছেন? পদার্থ বিজ্ঞানেও তাঁর রয়েছে অসীম দক্ষতা। তাই তো বিখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী অসীম রায় বলেছেন, ‘জগদীশ চন্দ্র বসু আমাদের আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।

বিজ্ঞানী মার্কনি রেডিও আবিষ্কারের আগেই বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু (Jagadish Chandra Bose) বিনা তারে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তথ্য-সংকেত বিনিময়ে সক্ষম হয়েছিলেন এবং প্রদর্শনও করেছিলেন। পদার্থবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখায় তিনি বিভিন্ন সমস্যা সামধানের চেষ্টা করেছিলেন। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ ছিল, বিশেষ করে জীব পদার্থবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান ও পুরাতত্ত্ব—এগুলো নিয়েও তাঁর কাজ আছে। এত কাজ তিনি কীভাবে করলেন তা নিয়েও কৌতূহল আছে।’

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর সংক্ষিপ্ত জীবনী

জন্ম ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি।
মৃত্যু ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭ (বয়স ৭৮) গিরিডি।
পিতা ও মাতা পিতার নাম ভগবানচন্দ্র বসু  ও মাতা বামাসুন্দরী দেবী।
শিক্ষায়তন হেয়ার স্কুল, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্রাইস্ট কলেজ, কেমব্রিজ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়।
পরিচিতির কারণ মিলিমিটার তরঙ্গ, বেতার, ক্রেসকোগ্রাফ, উদ্ভিদবিজ্ঞান
দাম্পত্য সঙ্গী অবলা বসু।
পুরস্কার সিআইই (১৯০৩), সিএসএই (১৯১১), নাইট ব্যাচেলর (১৯১৭)
প্রতিষ্ঠান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়

জন্ম

১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের বিক্রমপুর জেলার রাঢ়িখাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। 

পিতা ও মাতা

পিতা ভগবান চন্দ্র বসু ১৮৫৩ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। এরপর তিনি ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। কিন্তু সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার সত্ত্বেও নিজের ছেলেকে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করাননি। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি হন। 

পড়াশোনা

তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ফরিদপুরের একটি স্কুল থেকে। এরপর মাত্র ১১ বছর বয়সে কলকাতা পাড়ি দেন। জগদীশ কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। এরপর ১৮৭৯ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে বি.এ পাশ করেন। এই কলেজের একজন তাঁকে বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত করেন।

এরপরই তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পিতা ভগবান চন্দ্র রাজি ছিলেন না। পরে বাবার ইচ্ছা তে ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যে লন্ডন পাড়ি দেন । কিন্তু অসুস্থতার কারণে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি।

এরপর প্রকৃতিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এরপর ১৮৮৪ তে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ শেষ করেন। 

Read More: স্যার আইজ্যাক নিউটনের জীবনী - জন্ম পরিচয়, শিক্ষা ও কর্মজীবন, বিজ্ঞানের অবদান, গতি সূত্র

কর্মজীবন

১৮৮৫ তে ভারতে ফিরে আসেন। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। কিন্তু এখানে তিনি কম বেতন পেতেন। আর তাই একসময় বেতন নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রতিবাদ করায় তাঁর বেতন ইউরোপীয়দের সমতুল্য করা হয়। 

এই কলেজে গবেষণার কোনো ব্যবস্থা ছিলনা, তাই একটি ছোট্ট ঘরে তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে গেছেন। এরপর তিনি বেতার নিয়ে গবেষণা করেন।  এই কলেজে অধ্যাপনার সমস্ত হিসাব লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এই সূত্র ধরেই ১৮৯৬ সালের মে মাসে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে।

গবেষণার বিষয়

জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার বিষয় ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোনো তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণ করে সফলতা লাভ করেন। সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। একেই বলে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ।

এর মাধ্যমেই বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদানপ্রদান ঘটতে থাকে। এর ফলাফল হিসেবে আবিস্কৃত হয় রেডিও।  ড: দিবাকর সেনের মতে,

'মাইক্রোওয়েভ আবিষ্কারের ব্যাপারটা ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আজকের দিনে মহাকাশ বিজ্ঞানে, চিকিৎসা বিজ্ঞানে, টেলিভিশন সম্প্রচারে এবং বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে মাইক্রোওয়েভ কাজে লাগে। কম্যুনিকেশনের (যোগাযোগ) ক্ষেত্রে আরও বিশেষ করে এই তরঙ্গ কাজে লাগে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যখন সাবমেরিন এলো, রাডার এলো, তখন মানুষ বুঝতে পারল এই মাইক্রোওয়েভের গুরুত্ব কতখানি। তিনি যখন এই আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তার কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল না। মার্কনি এবং তদানীন্তন বিজ্ঞানীরা যোগাযোগের জন্য যে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ ব্যবহার করেছিলেন তা তারা করেছিলেন লঙ্গার ওয়েভ (দীর্ঘ তরঙ্গ) ব্যবহার করে- মাইক্রোওয়েভ ব্যবহার করে নয়। চৌকো মুখ ফানেল আকৃতির একটি হর্ন অ্যান্টেনা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, যা আজ বিশ্বে যুদ্ধকালীন যোগাযোগ, বা রাডার যোগাযোগের জন্য অপরিহার্য। এছাড়াও অনেক ধরনের রিসিভার উনি তৈরি করেছিলেন যা আজও বহুল ব্যবহৃত'। 

মাইক্রোওয়েভ রিসিভার ও ট্রান্সমিটারের উন্নয়ন, এবং ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র। তিনি  এই যন্ত্র দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। 

ড. দ্বিজেন শর্মা বলেন, 'গাছের যে প্রাণ আছে তার কিছু স্থূল লক্ষ্মণ সম্পর্কে মানুষ জানত, যেমন গাছ জন্ম নেয়, বড় হয়, একদিন মরেও যায়। কিন্তু বাইরের কোন উদ্দীপক বস্তু ব্যবহার করলে বা গাছকে আঘাত করলে গাছ কীভাবে সাড়া দেয়, সেটা জগদীশ বসু যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করে দেখান, যা উদ্ভিদ বিজ্ঞানের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার।

তিনি বলেছিলেন জড় এবং জীব জগতের মধ্যে পার্থক্য খুবই সামান্য। এতই সামান্য যেখানে জড় পদার্থ জীবের মত আবার জীব জড় পদার্থের মত ব্যবহার করে '। ছোটোবেলায় জগদীশ চন্দ্র পিতাকে প্রশ্ন করেছিলেন “বনচাঁড়াল আর লজ্জাবতী গাছের লতা ছুয়েদিলে নুইয়ে পড়ে। কিন্তু আম জাম কাঁঠাল গাছের পাতা কেমন আচরণ করে না কেন?”

পিতা উত্তর দিতেন, “হয়তো সব গাছের সাড়া দেওয়ার পদ্ধতি একরকম নয়। তবে মুনি-ঋষিরা বলে গেছেন মানুষ এবং পশু পাখির মধ্যে যেমন প্রাণ আছে গাছেরও তেমন প্রাণ আছে। তুমি বড় হয়ে ব্যাপারে আরও জানার চেষ্টা করো।”

বিবাহ

ব্রাহ্মসমাজের বিখ্যাত সংস্কারক দুর্গামোহন দাশের কন্যা অবলার সাথে ১৮৮৭ সালে জগদীশ চন্দ্র বসুর বিবাহ হয়। বিয়ের পর ভালো করে সংসার জীবন করার জন্য পড়াশোনা ছেড়ে দিলেন অবলা। স্বামীর বিজ্ঞান সাধনার পাশে সবসময় থেকেছেন তিনি। 

গ্রন্থ

তাঁর লেখা প্রথম গ্রন্থ "Response In The Living And Nonliving"। তিনি বাংলা ভাষায় লিখেছেন বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ, যার নাম অব্যক্ত। এছাড়াও ১৯০৬ এবং ১৯০৭ এ লেখেন, “উদ্ভিদের সাড়া” এবং “তুলনামূলক বৈদ্যুতিক শরীরবৃত্ত” নামে দুটি গ্রন্থ।

Read More: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর জীবনী - জন্ম, পিতামাতা, বানী, সমাজ সংস্কার, বাল্য বিবাহ ও নারীশিক্ষা বিস্তারে অবদান

মৃত্যু

১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে জগদীশ চন্দ্র বসু পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর পর তাঁর সঞ্চিত ১৭ লক্ষ টাকার মধ্যে ১৩ লক্ষ টাকা বসু বিজ্ঞান মন্দিরকে দান করেন।

উল্লেখযোগ্য তথ্য

১) ৪ ঘন্টা শিক্ষকতা করার পর যেটুকু সময় পেতেন, সেইটুকু তাঁর গবেষণার কাজে ব্যয় করতেন। 

২) স্বল্প ব্যয়ে স্থানীয় মিস্ত্রিদের শিখিয়ে পড়িয়ে উপকরণ প্রস্তুত করতেন। 

৩) জগদীশ চন্দ্রের শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকার "JBNSTS" নামে একটি বৃত্তি প্রদান করেন। 

৪) জগদীশ চন্দ্রের পৈতৃক বাড়িটি ১৯৯৪ সালে একটি স্কুল ও কলেজে পরিণত করে নাম রাখা হয় জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন ও কলেজ।

৫) জগদীশ চন্দ্র বসুকে রেডিও বিজ্ঞানের একজন জনক বলা হয়। 

সম্মাননা

১) ১৯০৩ সালে Companion of the Order of the Indian Empire উপাধিতে ভূষিত করা হয়। 

২) ১৯১১ সালে C.S.I উপাধি প্রদান করা হয়। 

৩) ১৯১৭ সালে Knight Bachelor উপাধি প্রদান করা হয়। 

৪) ১৯২০ সালে রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। 

৫) ২০০৯ সালে বোটানিকাল  গার্ডেনটির  নাম  রাখা হয়  Acharya Jagadish Chandra Bose Indian Botanic

Garden।

Read More: চলচ্চিত্রের রূপকার সত্যজিৎ রায় জীবনী - বাংলা চলচ্চিত্রে অবদান, সাহিত্য পুরস্কার

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনী প্রশ্নোত্তর (Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali - FAQ)

জগদীশ চন্দ্র বসু কোথায় ও কবে জন্মগ্রহণ করেন?

৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ ,বিক্রমপুর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি।

জগদীশ চন্দ্রের বিখ্যাত গন্থের নাম কী?

অব্যক্ত।

জগদীশ চন্দ্রের পিতা ও মাতার নাম কী?

পিতার নাম ভগবানচন্দ্র বসু ও মাতা বামাসুন্দরী দেবী।

জগদীশ চন্দ্র বসুর স্ত্রীর নাম কী?

অবলা বসু।

জগদীশ চন্দ্র বসু কবে মারা যান?

১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ভারতের ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে।

... ...

শেষকথা

অসংখ্য ধন্যবাদ BongHood.Com এর মাধ্যমে জগদীশ চন্দ্র বসুর জীবনী (Acharya Jagadish Chandra Bose Biography in Bengali) টি শেষ পর্যন্ত পড়ার জন্য। আরও নিত্যনতুন ও জানা অজানা তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইট টি ভিজিট করবেন এবং আমাদের সাথে থাকবেন। আমরা আমাদের সাইটে পোস্ট গুলি নিয়মিত আপডেট করি। 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url