সত্যজিৎ রায় জীবনী | Satyajit Ray Biography in Bengali

Satyajit Ray Biography in Bengali

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির উজ্জ্বলময় জ্যোতিষ্ক সত্যজিৎ রায় (Satyajit Ray) বাঙালির লেজেন্ড। শুধু চলচ্চিত্রে নয়, বাংলা সাহিত্যেও রয়েছে অগাধ পান্ডিত্য। শুধু সাহিত্য নয়, শিল্পকলাতেও জড়িয়ে তিনি। এমন এক মানুষ তো বাংলার লেজেন্ড হবেই। তিনি ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক, লেখক, কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক। আজ তাই এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল সত্যজিৎ রায়ের জীবনী। (Satyajit Ray Biography in Bengali)

সত্যজিৎ রায়ের জীবনী

জন্ম ২ মে ১৯২১
জন্মস্থান কলকাতা
পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের মসুয়ার।
পিতা ও মাতা সুকুমার রায়  ও সুপ্রভা দেবী।
পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
ডাকনাম মানিক
পড়াশোনা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা প্রেসিডেন্সি।
পেশা চলচিত্রকার, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, অঙ্কনশিল্পী, লেখক।
কর্মজীবন ১৯৫০ – ১৯৯২।
দাম্পত্য সঙ্গী বিজয়া দাস (১৯৪৯–১৯৯২)।
সন্তান সন্দীপ রায়।
উচ্চতা ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি।
সম্মান ভারত রত্ন।
মৃত্যু ২৩ এপ্রিল ১৯৯২।
সত্যজিতের জীবনীগ্রন্থ 'পোর্ট্রেট অফ আ ডিরেক্টর- সত্যজিত্‍ রে'।

সত্যজিৎ রায়ের জন্ম

১৯২১ সালের ২ মে কলকাতার সাহিত্য ও শিল্প সমাজে খ্যাতনামা রায় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন সত্যজিৎ রায়। তবে পূর্ব পুরুষের ভিটে ছিল ভারতের কিশোরগঞ্জের (বাংলাদেশ) মসূয়া গ্রামে। 

পিতা ও মাতা

পিতার নাম সুকুমার রায় এবং মাতা সুপ্রভা দেবী। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যের ননসেন্স ও শিশু সাহিত্যের সেরা লেখক বলে পরিচিত। সত্যজিৎ রায়ের যখন বয়স মাত্র তিন বছর তখনই হারান পিতাকে। এইসময় ছেলেকে নিয়ে চলে আসেন ভাইয়ের বাড়িতে।

খুব কষ্ট করে ছেলেকে বড় করেন। সংসারের অভাব দূর করতে সুপ্রভা দেবী বিদ্যাসাগর বানীভবন বিদ্যাশ্রমে সেলাইয়ের কাজও করেছিলেন। সেলাইয়ের কাজের জন্য দক্ষিণ কলকাতা থেকে বাসে করে উত্তর কলকাতায় রোজ যাতায়াত করতেন।

পিতামহ

সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন লেখক, চিত্রকর, দার্শনিক, প্রকাশক ও শখের জ্যোতির্বিদ। 

পড়াশোনা

১০ বছর বয়সে বালিগঞ্জ হাইস্কুলে ভর্তি হন। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়তে যান। ১৯৩৮ এ বি.এ পাস করেন। এসব পড়াশোনা করলেও কিন্তু তাঁর ঝোঁক ছিল চারুকলার উপর। আর তাই ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনের  বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

আর সেখানে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নন্দলাল বসু এবং বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখেন। 

কর্মজীবন

১৯৪০ খ্রিঃ এর এপ্রিল মাসে ভিসুয়ালাইজার হিসেবে ব্রিটিশ বিজ্ঞাপন কোম্পানি ডিজে কিমার সংস্থায় যোগ দেন। তখন বেতন ছিল মাত্র ৮০ টাকা। এরপর সিগনেট প্রেস প্রকাশনে বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার কাজ করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের  'পথের পাঁচালী', ' আমআঁটির ভেঁপু 'র উপরেও কাজ করেন।

অক্ষরলিপিতেও দক্ষতা অর্জন করেন। কয়েকদিনের মধ্যেই বিজ্ঞাপন জগতে বড় সাফল্য লাভ করে। কিন্তু ১৯৫৬ তে পথের পাঁচালীর সাফল্যের পর চাকরি ছেড়ে দেন। এ প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছেন, “বিজ্ঞাপনের কাজ ছেড়ে যখন সিনেমার কাজে অগ্রসর হই তখন আমার কাছে চলচ্চিত্রের প্রধান আকর্ষণ ছিল শিল্পের আকর্ষণ।

অবশ্যি সেই শিল্প মারফত কায়েমি ভাবে একটা রোজগারের বন্দোবস্ত হতে পারে এমন আশাও ছিল। কাজের আনন্দ এবং কাজের পারিশ্রমিক, এই দুই-এরও অতিরিক্ত কিছু যে চলচ্চিত্র থেকে লাভ হতে পারে সেটা গোড়ায় জানা সম্ভব ছিল না ”।

বিবাহ

১৯৪০-এর দশকে যেখানে প্রেম করে বিয়ে করা অসম্ভব, সেখানেই বিজয়া দাস দেখিয়েছেন তাঁর কৃতিত্ব। শুধু প্রেম নয়, নিজের থেকে বয়সে ছোট পিসতুতো ভাই কে বিয়ে করেছেন। বিজয়া দাসের পিসতুতো ভাই সত্যজিৎ রায়। দীর্ঘ আট বছর প্রেমের পর ১৯৪৮-এর ২০ অক্টোবর তৎকালীন বোম্বে-তে লুকিয়ে বিয়ে করেন দুজনে। এরপর ১৯৪৯-এর ৩ মার্চ পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে হয়।

বাংলা চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায়ের অবদান

কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারের সাথে সাক্ষাৎ এবং লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী চলচ্চিত্র লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে (ইতালীয়: Ladri di biciclette, বাইসাইকেল চোর) দেখার পর চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হন। এরপর ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন।

তাঁর বিখ্যাত প্রথম সিনেমা পথের পাঁচালী (১৯৫৫) ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে। শুধু তাই নয়, ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানুষে-আবর্তিত প্রামাণ্যচিত্র” (Best Human Documentary) পুরস্কার লাভ করে। এই ছবিটি ১১ টি পুরস্কার লাভ করে।

পথের পাঁচালী, অপরাজিত (১৯৫৬) ও অপুর সংসার (১৯৫৯) এই তিনটি সিনেমা পরপর তৈরি করেন, যা পরিচিত অপু ত্রয়ী নামে। ১৯৫৫ খ্রিঃ এপ্রিলে নিউইয়র্কে প্রথম প্রকাশিত হয় পথের পাঁচালী। এরপর ২৬ শে আগস্ট কলকাতায় মুক্তি পায়। এখান থেকেই শুরু হয় চলচ্চিত্র যাত্রা।

সত্যজিৎ রায় এতদিন সাদা কালো ছবি করে আসছিলেন, আর তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়েছিল রঙিন ছবি। প্রথম রঙিন বাংলা ছবি 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'। যা মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। বাংলার পাশাপাশি পরিচালনা করেছেন হিন্দি ছবিও। তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি শতরঞ্জকে খিলাড়ি (১৯৭৭ খ্রিঃ)। এছাড়াও করেছেন তথ্যচিত্র, রবীন্দ্রনাথ, সিকিম, সুকুমার রায়।

বিখ্যাত চলচ্চিত্র | সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা

  • জলসাঘর 
  • কাঞ্চনজঙ্ঘা 
  • অভিযান 
  • মহানগর 
  • চারুলতা 
  • ঘরেবাইরে 
  • গণশত্রু 
  • শাখাপ্রশাখা 
  • আগন্তুক

পুরস্কার ও সম্মাননা

তিনি ১৯৯২ সালে পেয়েছেন একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার (অস্কার)। এছাড়াও পেয়েছেন ২টি রৌপ্য ভল্লুক, ৩২টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১টি গোল্ডেন লায়ন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে ভারত রত্ন এবং পদ্মভূষণসহ নানান পুরস্কার। ১৯৮৫ সালে পান 'দাদাসাহেব ফালকে'।

১৯৮৭ সালে ফরাসি সরকারের থেকে পান 'লেজিওঁ দনরে'। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে পান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  'ডি লিট' উপাধি। এর আগে প্রথম পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন। তিনি মোট ৩২টি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। 

বাংলা সাহিত্যে অবদান

সত্যজিৎ রায় শুধু সিনেমা নয়, বেশ কয়েকটি ছোট গল্প এবং উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র ফেলুদা এবং প্রফেসর শঙ্কু দর্শক মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এছাড়াও তপশে, জটায়ু সকলেরই পছন্দের চরিত্র। 

খাদ্যরসিক

সব গুণাবলীর মধ্যে তিনি ছিলেন বেশ খাদ্যরসিক একটা মানুষ। শ্যুটিং এ থাকাকালীন খেতেন চিকেন কাটলেট, চিকেন স্যান্ডউইচ এবং টক দই । এছাড়াও পছন্দের খাবার ছিল, ফিশ ফ্রাই, হ্যাম স্যান্ডউইচ, ভেটকি মুনিয়া ইত্যাদি।

মৃত্যু

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায়ের জীবনাবসান হয়। এই বছর পান মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার। তাঁর বদলে গ্রহণ করেছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। 

উল্লেখযোগ্য তথ্য

  • পথের পাঁচালী ছবি বানাতে গিয়ে ভীষণ অর্থকষ্টে ভুগতে হয়। আর তাই তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সিনেমার কাজ শেষ করেন।
  • প্রথম যখন পথের পাঁচালী ছবির কাজ করতে নামেন তখন তিনি জানতেন না, ছবির জন্য স্ক্রিপ্ট লিখতে হয়। যখন তাঁর কাছ থেকে সহ পরিচালক স্ক্রিপ্ট চান, তখন তিনি তাঁকে উত্তর দেন, 'স্ক্রিপ্টের কী দরকার? আমি যা বলবো ওরা তাই করবে বলবে। আলাদা করে স্ক্রিপ্টের কী দরকার?' এরপর তিনি বলেন, 'ঠিক আছে পেন আর কাগজ নিয়ে এস। আমি লিখে দিচ্ছি।' এরপরই তৎক্ষণাৎ কাগজের টুকরো তে ছবি এঁকে এঁকে লিখে ফেললেন স্ক্রিপ্ট। 
  • ১৯৮৩ সালে ‘ঘরে বাইরে’ ছবি করতে করতে হার্ট অ্যাটাক হয়, এরপর ছেলে সন্দীপ রায়ের সহায়তায় এই ছবির কাজ শেষ করেন। 
  • বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রাম ছিল সত্যজিৎ রায়ের পৈতৃক ভিটে, এই জায়গাকে বলা হয় ‘পূর্ব বাংলার জোড়াসাঁকো’। কারণ কলকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যেমন সকলেই শিল্প-সাহিত্যে নিপুণ, আর সত্যজিৎ রায়ের বাড়িও অনুরূপভাবে সকলেই শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী। 
  • জাপানী চলচ্চিত্রকার আকিরা কুরোসাওয়া তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, 'সত্যজিৎ এর চলচ্চিত্র না দেখার অর্থ হলো আপনি পৃথিবীতে বাস করেও চন্দ্র-সূর্য দেখছেন না।'
  • লিখেছেন শ্যামাসংগীত। 'যে বলে মা তুই পাষানী/তারে আমি বেকুব মানি/আমি প্রাণে জানি পাষণের কী মহিমা/এবার তোরে চিনেছি মা/ও তোর নামে কালী, মুখে কালী অন্তরে তোর নেই কালিমা।'
  • সত্যজিৎ রায় নির্মিত 'সোনার কেল্লা' ছবিতে তোপসের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তাঁর ছেলে সন্দীপ রায়ের শাশুড়ি। অর্থাৎ সত্যজিতের পুত্রবধূ ললিতা রায়ের মা রেখা চট্টোপাধ্যায়।

সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্নোত্তর (FAQ)

সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র কোনটি?

সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত প্রথম সিনেমার (চলচ্চিত্র) নাম পথের পাঁচালী। যেটি ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে।

সত্যজিৎ রায় কোন ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

শিল্পচর্চার ইতিহাসের সাথে যুক্ত ছিলেন।

সত্যজিৎ রায় সর্বমোট কতগুলি পুরস্কার পেয়েছেন?

৩২ টি

সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমা গুলির নাম কি?

পথের পাঁচালি, অপরাজিত, গুপী গাইন বাঘা বাইন, জলসাঘর, হীরক রাজার দেশে, চিড়িয়াখানা, অশনি সঙ্কেত ইত্যাদি।

সত্যজিৎ রায় কে ছিলেন?

সত্যজিৎ রায় ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সংগীত পরিচালক, লেখক, কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।

... ...
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url