রাজা রামমোহন রায় জীবনী | Raja Ram Mohan Roy Biography in Bengali
ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়। যিনি সূচনা করেছিলেন, নতুন জীবনের, নতুন জাগরণের । তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ। তাঁরই জীবন সম্পর্কে আমরা অল্প কিছুই জানি। সেই কারণে আজকে আমরা রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
রাজা রামমোহন রায়ের জীবনী
জন্ম | ২২ মে, ১৭৭২ |
মৃত্যু | ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৩ (বয়স-৬১) |
জন্মস্থান | রাধানগর, হুগলী। |
মৃত্যু স্থান | স্ট্যাপলেটন, ব্রিস্টল |
পিতা ও মাতা | রমকান্ত রায় (বাবা) তারিণী দেবী (মা) |
রাজা রামমোহন রায়ের জন্ম পরিচয়
১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রাজা রামমোহন রায়। তাঁর পিতার নাম রমকান্ত রায় ও মাতার নাম তারিণী দেবী। রামমোহনের সঙ্গে বাবা মায়ের সম্পর্ক কোনো কালেই ভালো ছিল না। পিতার মৃত্যুর পর তাঁকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেন তারিণী দেবী। শৈশবে একবার মামার বাড়ি যান রামমোহন। দাদু শ্যাম ভট্টাচার্য রামমোহনের হাতে পূজোর বেলপাতা দিয়েছেন, রামমোহন ঠাকুরের কাছে অর্পণ না করে মুখে নিয়ে চিবোচ্ছিলেন। এই দৃশ্য দেখে তারিণী দেবী থাপ্পড় মারেন অনেক কথা শোনান। এই ঘটনা দেখে তাঁর দাদু তাঁর মাকে বলেন, ‘তুই পুজোর বেলপাতা এ ভাবে ফেলে দিলি! এ ছেলেকে নিয়ে তুই কখনও সুখী হবি না। তোর ছেলে বিধর্মী হবে।’ রামমোহনের বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো ছিলনা। রামমোহনের মাছ খাওয়া নিয়ে, তাঁর আরবি শিক্ষা, কোরান পড়া, সুফিবাদী বইপত্র অধ্যয়ন নিয়ে সবসময় ঝামেলা লেগেই থাকত। তাই বাড়ি থেকে চলে যেতে হয় তাঁকে। এমনকি পিতার মৃত্যুর পর মাকে শ্রাদ্ধের টাকা দিতে এলে, মা নেয়না। নিজের গয়না বন্দক দিয়ে শ্রাদ্ধ করেন। পাশাপাশি রামমোহনকে জানিয়ে দেয়, এই স্লেচ্ছ ছেলের হাত থেকে টাকা নেবেননা।
রাজা রামমোহন রায়ের শিক্ষাজীবন
ছোটো থেকেই লেখাপড়ার প্রতি ছিল প্রবল আগ্রহ। মাত্র ৮ বছর বয়সে গ্রামের স্কুলে বাংলা এবং আরবীভাষা শেখেন। তারপর পাটনায় গিয়ে আরবী ও ফারসি শেখেন। বাবা রামকান্ত ভাবলেন ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলবেন তাই রামমোহনকে পাঠালেন কাশীতে। এরপর ১২ বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষা শেখার জন্য কাশীধামে যান।
রাজা রামমোহন রায়ের কর্মজীবন
শিক্ষাজীবন শেষ করে তরুণ বয়সে রামমোহন কলকাতায় মহাজনের কাজ করতেন। এরপর ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু রামমোহন বেশিদিন চাকরি করেননি। সাহিত্য সাধনাও সমাজ সংস্কারের জন্য মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। পরে কলকাতার মানিকতলায় বাড়ি কিনে থাকেন। এখানেই প্রতিষ্ঠা করেন আত্মীয় সভা। এরপর তিনি বাংলায় ব্রাহ্মণ পত্রিকা এবং ইংরেজীতে ইষ্ট ইন্ডিয়া গেজেট দুটো পত্রিকা বের করেন।
হিন্দুধর্মের বিরোধী
রামমোহন মূর্তি পূজা মানতেন না। আর তাই তিনি হিন্দুদের পৌত্তলিক ধর্মপ্রণালী নামে একটি বই রচনা করেন। রামমোহন পিতাকে বললেন মূর্তি পূজা করা মানে মিথ্যার আরাধনা করা। তারপর তার ওই বই পড়ে তাঁর পিতা তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হন। যার কারণে তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। পিতা রামকান্ত বলেন বিধর্মী, নাস্তিক, কুলাঙ্গার বাড়ি থেকে বেরোও।
রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি ত্যাগ
১৫ বছর বয়সে বাড়ি ত্যাগ করে তিনি তিব্বতে চলে যান। বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া রামমোহনের জীবনের যেন মুক্তি পাওয়া। ঘুরে দেখলেন গোটা দেশ। ১৭৯০ সালে আবার বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর পৈতৃক বাড়ি পরিত্যাগ করে , পাশের গ্রাম লাঙ্গুলপাড়াতে বসতি স্থাপন করেন।
সতীদাহ ও রামমোহন
সারা ভারতে ঘুরে দেখলেন সতীদাহ প্রথার নির্মম রূপ। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, দিল্লির এক শেঠজি স্বর্গে গেছেন। শেঠজি কোটিপতি। ঘরে তাঁর চার-চারটি স্ত্রী। দলে দলে খিদমদগার, হুঁকোবরদার। যমুনার ধারে কয়েকশো মণ চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি করা হল আকাশ-ছোঁয়া চিতা। চিতায় শেঠজির সঙ্গে উঠলেন তাঁর চারটি স্ত্রী। কিন্তু অমন মানী লোকের স্বর্গে গিয়ে চারটি স্ত্রীতেই কেবল কুলোবে কেন? এত এব ঝি-চাকরকেও স্বর্গে যেতে হল তাঁর সঙ্গে। তামাক সাজবে কে– পা টিপে দেবে কে– হাওয়া করবে কে? সেইখানেই শেষ নয়। দুটো প্রকাণ্ড আরবি ঘোড়াকেও চিতায় চড়িয়ে দেওয়া হল। আবার ঘোড়া কেন? বা-রে নইলে শেঠজির মতো অমন দিকপাল লোক কিসে চড়ে স্বর্গের দেউড়িতে ঢুকবেন? এমনই ছিল সে যুগের কুসংস্কার। আজ আমাদের হাসি পায়– কিন্তু সে দিন রামমোহনের চোখ ফেটে জল এসেছিল। দুঃখে, লজ্জায়, ক্ষোভে। এই ইতিহাস বদলাতে হবে। এই অজ্ঞানতার পাপকে মুছে দিতে হবে চিরকালের জন্য। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে এক মন্ত্রে মিলিয়ে দিয়ে সারা ভারতবর্ষে একটি মহাজাতিকে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই মিলনমন্ত্র আসবে এই দেশের উপনিষদ থেকেই। সংস্কারের অজ্ঞতায় যা আমরা হারিয়েছি, তার পুনরুদ্ধার করবেন তিনি। সেই সংকল্প বুকে নিয়েই চার বছর পরে রামমোহন রায় দেশে ফিরলেন।’
১৮১২ সালে তাঁর ভাই মারা যান, আর সেইসময় তাঁর ভাইয়ের স্ত্রীকে চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়। এই নির্মম দৃশ্য চোখে দেখে তিনি মেনে নিতে পারেননি। এই ঘটনা তাঁর মনে তীব্র প্রভাব ফেলে। আর তাই তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এই প্রথার বিরুদ্ধে একটি বাংলা পুস্তক রচনা করেন। তখনকার দিনে যা হত সব শাস্ত্র মেনে হত। আর তাই তিনি মনুসংহিতা সহ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে প্রমাণ করেন সতীদাহ প্রথা অন্যায়। এছাড়াও তিনি সম্বাদ কৌমুদী সহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ক কথা প্রকাশ করতেন। এরপর নতুন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক এর কাছে একটি আবেদন পত্র দেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৮২৯ সালের ৪ ঠা ডিসেম্বর ১৭ নং রেগুলেটিং আইন পাস করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেন।
ব্রাহ্মসমাজ ও রামমোহন
রাজা রামমোহন রায় মূর্তি পূজার বিরোধী ছিলেন, আর তাই ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে গড়ে তুললেন ব্রাহ্মসমাজ। এই সমাজ গড়ার মূল লক্ষ্য ছিল , ধর্ম ভেদাভেদ দূর করা। এই সমাজের মূল বক্তব্য, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক ।
রামমোহনের বিয়ে
অনেকেই আমরা জানিনা রামমোহন বিয়ে করেছিলেন কিনা। তবে রামমোহন বিয়ে করেছিলেন, তৎকালীন ব্রাহ্মণ সমাজের প্রথা মেনে নয় বছর বয়সে তিনবার বিয়ে করেন। আর এই থেকেই তিনি বহুবিবাহের বিরোধিতা করেন। এমনকি তাঁর ছেলেদের বলে দিয়েছিলেন, স্ত্রী বেঁচে থাকা অবস্থায় যদি কেউ আবার বিয়ে করেন, তাহলে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে।
রাজা রামমোহন রায়ের গ্রন্থ
- বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫)
- বেদান্ত সার (১৮১৫)
- তলবকার উপনিষৎ (জুন, ১৮১৬)
- ঈশোপনিষৎ (জুলাই, ১৮১৬)
- ভট্টাচার্যের সহিত বিচার (মে, ১৮১৭)
- কঠোপনিষৎ (অগস্ট, ১৮১৭)
- মাণ্ডুক্যোপনিষৎ (অক্টোবর, ১৮১৭)
- গোস্বামীর সহিত বিচার (জুন, ১৮১৮)
- সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ (আনুমানিক নভেম্বর, ১৮১৮)
- গায়ত্রীর অর্থ (১৮১৮)
- মুণ্ডকোপনিষৎ (আনুমানিক ফেব্রুয়ারি/মার্চ, ১৮১৯)
- সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (নভেম্বর, ১৮১৯)
- আত্মানাত্মবিবেক (১৮১৯)
রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু
ইউরোপের কিছু দেশ ঘুরে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে থাকাকালীন মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হন। প্রায় আটদিন জ্বরে ভুগে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ১৮৩৩ সালে রাত দুটো পঁচিশ নাগাদ মৃত্যু হয়। মৃত্যুর দশ বছর পর 'আনসার ডেল' নামক স্থানে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমাধিস্থ করে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন । এছাড়াও মধ্য ব্রিস্টলে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
রাজা রামমোহন রায় সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য
- ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর রামমোহনকে রাজা উপাধি দেন দিল্লির বাদশা।
- ১৯১৬ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নকশায় তৈরী হয় তাঁর রাধানগরের বাড়ি। এই বাড়ির বর্তমান নাম 'রামমোহন মেমোরিয়াল হল' ।
- রাজা রামমোহনের শেষ জীবনের ডাক্তার ছিলেন, ডাক্তার এস্টলিন। রাজা রামমোহনের মৃত্যুর পর ‘ডেথ মাস্ক’ তুলে রাখা হয়েছিল। ডাক্তারের ডায়েরী থেকে জানা যায়, “মর্মরশিল্পী পাগ (Pugh) এক ইতালিয়ান [সহকারী]কে সঙ্গে নিয়ে এসে রাজার মাথা ও মুখের ছাঁচ তুলে নিল। আর এই ছাঁচটি মিস এস্টলিন (ডাক্তারের মেয়ে) এর কাছে সংরক্ষিত আছে।”
- রামমোহন ছিলেন খাদ্যরসিক বাঙালী। গোটা একটা পাঁঠার মাংস খেয়ে নিতে পারতেন। নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় ছিল পঞ্চাশটি আম, এক কাঁদি নারকেল আর বারো সের দুধ।
- রামমোহনের দৈর্ঘ্য ছিল ৬ ফুটেরও বেশি। বেশ লম্বা চওড়া ছিলেন। বুকের মধ্যে রাখতেন ধারাল ছোরা। হাতের লাঠিতে থাকত গোপন তরোয়াল।
- রামমোহন ছিলেন প্রথম আধুনিক মানুষ। তিনি ছিলেন মুক্ত, ঈশ্বর থেকে মুক্ত, কুসংস্কার থেকে মুক্ত। যুক্তিবাদী মনন ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তিনি এক নতুন সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্ন (FAQ)
রাজা রামমোহন রায় কে ছিলেন?
রাজা রাম মোহন রায় ছিলেন একজন বাঙালি দার্শনিক ও বাংলার নবজাগরণের আদিপুরুষ। তিনি ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রাজা রামমোহন রায় কে কেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়?
রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরেই ভারতের আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিলো। তিনি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ও মধ্যযুগীয় জড়তার হাত থেকে গোটা ভারতবাসীকে মুক্ত করে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন। তাই রাজা রামমোহন রায় কে ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ বলা হয়।
রাজা রামমোহন রায়ের কতজন স্ত্রী ছিল?
রাজা রামমোহন রায় ৩ বার বিয়ে করেছিলেন।
রামমোহন রায়ের দুটি গ্রন্থের নাম কি?
েদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্ত সার (১৮১৫), কঠোপনিষৎ (অগস্ট, ১৮১৭) ইত্যাদি।