বিপ্লবী শহীদ ক্ষুদিরাম বসু জীবনী - Khudiram Bose

Khudiram Bose Biography in Bengali

ক্ষুদিরাম বসুর জীবনী (Khudiram Bose Biography in Bengali): যেসব মানুষের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন হতে পেরেছি। আজ আমরা মাথা তুলে বেঁচে আছি, তাদের মধ্যে একজন হলেন ক্ষুদিরাম বসু (Khudiram Bose)। যিনি মৃত্যু মঞ্চে গেয়েছিলেন গান

একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি,
হাসি হাসি পরব ফাঁসি
দেখবে ভারতবাসি।

আমি হাসি হাসি পরব ফাঁসি
দেখবে ভারতবাসী
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি।
রইল তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী।

ক্ষুদিরাম বসুর জীবনী Khudiram Bose Biography in Bengali

জন্ম ৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯
জন্মস্থান মোহবনী (হবিবপুর), পশ্চিম মেদিনীপুর (ব্রিটিশ ভারত)।
মৃত্যু ১১ আগস্ট ১৯০৮ (বয়স ১৮)
মৃত্যু স্থান মুজাফফরপুর, বিহার, (ব্রিটিশ ভারত)। 
পিতা ও মাতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী।

ক্ষুদিরাম বসুর জন্মদিন

ক্ষুদিরাম বসু (Khudiram Bose) ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর জেলার কেশপুর থানার মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অপরূপা দেবী 'অতৃপ্ত ক্ষুদিরাম' প্রবন্ধে ক্ষুদিরামের জন্মের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, “নিরানব্বই সালের উনিশে অগ্রহায়ণ (৩রা ডিসেম্বর ১৮৮৯) মঙ্গলবার সন্ধ্যে

পাঁচটা হবে, ক্ষুদিরামের জন্ম হ’ল। সেদিন কি আনন্দ আমাদের। এর আগে পর পর দুটো ভাই মারা গেছে, আর আমরা বাঙালি ঘরে অভিসম্পাত তিন তিনটে বোন অজর-অমর হয়ে বেঁচে রইলাম – এ লজ্জা রাখবার যেন ঠাঁই পাচ্ছিলাম না। তাই ছোট ভাইটি যখন হ’ল কী আনন্দ আমাদের।

নবজাতক ভাইটিকে আমি কিনে নিলাম তিন মুঠো খুদ দিয়ে। আমাদের এদিকে একটি সংস্কার আছে, পরপর কয়েকটি পুত্রসন্তান মারা গেলে মা তার কোলের ছেলের ওপর সমস্ত লৌকিক অধিকার ত্যাগ করে বিক্রি করার মত ভান করেন। যে কেউ এসে কিনে নেন কড়ি দিয়ে নয়ত খুদ দিয়ে।

তিনটে কড়ি দিয়ে কিনলে নাম হয় তিনকড়ি। পাঁচকড়ি দিয়ে কিনলে নাম হয় পাঁচকড়ি। তিন মুঠো খুদ দিয়ে কিনলাম বলে ভাইটর নাম হল ক্ষুদিরাম।”

পিতা ও মাতা

পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার (ভূমি রাজস্ব আয়কর বিভাগের কাজ, বর্তমানে যাকে ইংরেজি পরিভাষায় বলে 'Tax collector' । মাতা ছিলেন লক্ষীপ্রিয়া দেবী। তিন কন্যার পর ক্ষুদিরামের জন্ম দেন লক্ষীপ্রিয়া দেবী। কিন্তু এর আগে তাঁর দুই পুত্র মারা যান, আর তাই এই ছেলে যাতে মারা না যায়,

আশঙ্কায় ৩ মুঠো চাল বা খুদের বিনিময়ে তাঁকে নিজের বড় দিদির কাছে দান করেন। তখন কার দিনে কথিত ছিল, যে নারীর সন্তান বাঁচেনা, তাঁকে অন্য কারোর কাছে গোত্রান্তর করলে মৃত্যুভয় চলে যায়। আর তাই ক্ষুদিরামকে দান করা হয়। আর এই ক্ষুদের বিনিময়ে পাওয়া গিয়েছে বলে, তাঁর নাম ক্ষুদিরাম। তাঁর দিদি অপরূপার কথায়,

‘তিনমুঠো ক্ষুদ দিয়ে ক্ষুদিরামকে কিনেছিলাম আমি। মনে মনে লোভ ছিল, ক্ষুদিরামকে একা ভোগ-দখল করব। কিন্তু কখিন যে আমার অগোচরে সে দেশের লোকের কাছে বিকিয়ে গেছে জানতেও পারি নি। তিনমুঠো ক্ষুদ দিয়ে আমি কিনেছিলাম। দেশের ছেলেরা তাকে কিনলো আঁজলা আঁজলা রক্ত দিয়ে।’ ক্ষুদিরামের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন

তিনি মাতাকে হারান। আর এর একবছর পর পিতাকে হারান। আর সমস্ত দায়ভার এসে পড়ল দিদি অপরূপার উপর। অপরূপার কথায়, ‘তখন সরোজিনী ও আমার  বিয়ে হয়ে গেছে, কেবল ননীবালার তখনও বিয়ে হয়নি, ক্ষুদিরামের বয়স তখন  ছয় বছরের  কিছু বেশি। এই দুইটি নাবালক তখন অনাথ ও নিরাশ্রয়।

এই দুজনের যাবতীয় ভার পড়ল  আমার উপর। আমরা মেদিনীপুর থেকে হাটগেছ্যা (দাশপুর) চললাম ননীবালা ও ক্ষুদিরামকে সঙ্গে নিয়ে।’

শিক্ষাজীবন

জামাইবাবু অমৃতলাল রায় ক্ষুদিরামকে তমলুকের হ্যামিল্টন হাই স্কুলএ ভর্তি করে দেন। এরপর তিনি পড়াশোনা করেন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে।

বৈপ্লবিক কাজকর্ম

মেদিনীপুরেই ঘটে তাঁর বিপ্লবী জীবনের অভিষেক। এখানেই তিনি বিপ্লবীদের তৈরী আখড়ায় যোগ দেন। যার নাম ছিল অনুশীলন সমিতি। নবম শ্রেণীতে পড়তে পড়তেই স্কুল ত্যাগ করতে হয়, তখন মাত্র ১৫ বছর। তখন তাঁর ধ্যান জ্ঞান ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে।  লাঠি চালানো থেকে শুরু করে বন্দুক চালানো সবই ছিল নখদর্পণে।

এই দলের নেতা ছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁরই নির্দেশনায় মেদেনীপুরের এক কৃষি ও শিল্পমেলায় বিপ্লবী পত্রিকা 'সোনার বাংলা' ইস্তেহার বিলি করে গ্রেফতার হন। কাঠগড়ায় তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘কে তোমাকে এই পুস্তিকা বিলি করবার দায়িত্ব দিয়েছে?’ এর উত্তরে তিনি জানান, ‘তার নাম বলতে পারি না।’

তারপর তাঁকে বলা হয়, ‘দেখো তো এই কক্ষে সেই ব্যক্তিটি আছে কিনা?’ তারপর চারিদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নাহ, এই ঘরে তো সেই লোককে দেখতে পাচ্ছি না।’ বিচারকরা ভাবল, ছেলেটি ভুলমনা, তাই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হল। এরপরই দিদির বাড়িতে তে সন্দেহভাজন হয়ে গেল। আর তাই সব বুঝতে পেরে ক্ষুদিরাম বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।

আশ্রয় নেন আবদুল ওয়াহেদ সাহেবের সমাজ পরিত্যক্তা বোনের কাছে আশ্রয় নেন। এই মহিলা তাঁকে ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। ১৯০৬  এ রণপার সাহায্য নিয়ে কাঁসাই নদীর বন্যাত্রাণে কাজ করেন। এরপরই তিনি আয়ত্ত করে নেন, বোমা রাখা ও বোমা তৈরির কৌশল। এরপর ১৯০৭ এ নারায়ণগড় রেলস্টেশন বোমা বিস্ফোরণ ঘটান।

তাঁর এই সাহসিকতার জন্য কাঁধে এসে পড়ে গুরুদায়িত্ব। ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিল ঘটে সেই ঘটনা। সঙ্গী প্রফুল্ল চাকী কে সাথে নিয়ে শুরু হয় সেই কাজ। মুজফ্ফরপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড কে হত্যার দায়িত্বভার এসে পড়ে তাঁদের উপর। কিংসফোর্ড বাংলার বিপ্লবীদের খুবই নৃশংসভাবে অত্যাচার করতেন।

আর এই অত্যাচার থেকে সকলকে  বাঁচাতে তাঁকে হত্যা করতে হবে। আর তাই সুযোগ বুঝে কিংসফোর্ডের গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা ছোঁডেন। কিন্তু ওই গাড়িতে ছিলেননা কিংসফোর্ড। সেখানে ছিলেন ব্রিটিশ অফিসার প্রিঙ্গল কেনেডির স্ত্রী ও মেয়ে। এরা মারা যান। কিন্তু বেঁচে যান কিংসফোর্ড। আর এই ঘটনার পর গ্রেফতার হতে হয়, ক্ষুদিরামকে।

কিন্তু প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়ার আগেই ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ২ মে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন।

ক্ষুদিরাম বসুর মৃত্যু দিন

কিংসফোর্ডকে হত্যার অপরাধে গ্রেফতারের পর ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয়। তখন বয়স ছিল, ১৮ বছর ৮ মাস ৮ দিন। ১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট ভোর ৬ টার সময় মুজফ্ফপুর জেলে ফাঁসি হয়।

ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কেন হয়েছিল

‘বেঙ্গলী’ পত্রিকার সংবাদদাতা উপেন্দ্রনাথ সেন লিখেছেন, “মঞ্চে উপস্থিত হইলে তাহার হস্ত দুইখানি পিছন দিকে আনিয়া রজ্জুবদ্ধ করা হইল।

একটি সবুজ রঙের পাতলা টুপি দিয়া তাহার গ্রীবামূল অবধি ঢাকিয়া দিয়া গলায় ফাঁসি লাগাইয়া দেওয়া হইল। ক্ষুদিরাম সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, এদিক ওদিক একটুও নড়িল না। উডম্যান সাহেব ঘড়ি দেখিয়া একটা রুমাল উড়াইয়া দিলেন। একটি প্রহরী মঞ্চের একপ্রান্তে অবস্থিত হ্যাণ্ডেল টানিয়া দিল।

ক্ষুদিরাম নীচের দিকে অদৃশ্য হইয়া গেল। কেবল কয়েক সেকেন্ড ধরিয়া উপরের দড়িটি একটু নড়িতে লাগিল। তারপর সব স্থির। চিতারোহণের আগে স্নান করাইতে গিয়া মৃতদেহ বসাইতে গেলাম। দেখিলাম, মস্তকটি মেরুদণ্ডচ্যুত হইয়া বুকের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। দুঃখ বেদনা ক্রোধে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে মাথাটি ঠিক করিয়া রাখিলাম।

বন্ধুগণ স্নান শেষ করাইলেন। তারপর চিতায় শোয়ানো হইলে রাশিকৃত ফুল দিয়া মৃতদেহ সম্পূর্ণ ঢাকিয়া দেওয়া হইল। কেবল উহার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা অনাবৃত রহিল। দেহটি ভস্মীভূত হইতে বেশি সময় লাগিল না। চিতার আগুন নিভাইতে গিয়া প্রথম কলসীভরা জল ঢালিতেই তপ্ত ভস্মরাশির খানিকটা আমার বক্ষস্থলে আসিয়া পড়িল।

তাহার জন্য জ্বালা যন্ত্রণা বোধ করিবার মত মনের অবস্থা তখন ছিল না।”

উল্লেখযোগ্য তথ্য

  1. যে কারাগারে ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তার বর্তমান নাম ক্ষুদিরাম বসুর (Khudiram Bose) নামেই নামকরণ করা হয়েছে।
  2. শোনা যায়, ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়েও তিনি হেসেছিলেন। যা দেখে অবাক হন বিচারক। এমনকি তিনি জল্লাদকে প্রশ্ন করেছিলেন, 'ফাঁসির দড়িতে মোম কেন লাগান হয়?' এই কথা শুনে জল্লাদও অবাক হয়ে যান।
  3. ফাঁসির আগের দিন অর্থাৎ ১১ ই আগস্ট আইনজীবী সতীশচন্দ্র চক্রবর্তীকে জানিয়েছিলেন, 'রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহর ব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।'
  4. ফাঁসির আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা ছিল, ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি পেলে, তাঁর বোমা বানানোর শিক্ষা অনান্য ভারতীয় সন্তানদের শিখিয়ে যেতে চান।
  5. ক্ষুদিরাম জানতেন না প্রফুল্ল চাকী মারা গেছেন, আর তাই তাঁকে বাঁচানোর জন্য সব দোষ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
  6. ১৩ জুন ফাঁসির রায় শোনার পর ক্ষুদিরামকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তুমি কি বুঝতে পেরেছো তোমাকে কী শাস্তি দেওয়া হয়েছে?’ তখন উত্তরে জানান, ‘হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি, এবং আমি আবার আসব।’
  7. তাঁকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল, ১৫ ফুট উঁচু এক ফাঁসির মঞ্চ, তার দুদিকে ছিল কাঠের খুঁটি, উপরে ছিল মোটা লোহার রড ছিল আর তারই মাঝখানে মোটা দড়িতে ফাঁসি দেওয়া হয়।
  8. কিংসফোর্ডকে হত্যা করার পরিকল্পনায় বোমা ছুড়েছিলেন প্রফুল্ল চাকী ওরফে দীনেশ। অর্থাৎ ক্ষুদিরাম মাত্র সহযোগী ছিলেন।
  9. ফাঁসির আগে ক্ষুদিরাম দিদিকে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দিদি আসতে পারেননি, কারণ তখন তাঁর জামাইবাবু রেলওয়েতে নতুন চাকরি পেয়েছে। নতুন চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে তিনি আসেননি, কিন্তু এসেছিলেন সেই পাতানো মুসলমান দিদি। যিনি কিনা ক্ষুদিরামকে আশ্রয় দিয়েছিলেন।
  10. ক্ষুদিরাম খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন। ভাগ্নে ললিতমোহন রায় লিখেছেন, ‘ক্ষুদিরাম বাঁশের বাঁশি সুন্দর বাজাইত। অবকাশ সময়ে সে বাঁশি বাজাইত, বাঁশিতে সে স্বদেশী গান গাহিত। সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। কখনো বা গভীর রাত্রে বাঁশিতে  গাহিত। আয় মা করালী কালী নেচে নেচে আয় গো, তুই  যে রক্ত  খেতে ভালবাসিস্ রক্ত খেতে আয় গো।’

ক্ষুদিরাম বসু জীবনী (প্রশ্নোত্তর) - Khudiram Bose FAQ

ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি কবে হয়েছিল?

১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট।

ক্ষুদিরাম বসুর পিতা ও মাতার নাম কী?

রৈলোক্যনাথ বসু ও লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী।

ক্ষুদিরাম কার কাছে মানুষ হন?

দিদির কাছে

ক্ষুদিরাম বসু কাকে মারার পরিকল্পনা করেছিলেন?

কিংসফর্ড কে।

ক্ষুদিরাম বসু কবে কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

৩ ডিসেম্বর ১৮৮৯

... ...
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url