কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনী - Jibanananda Das Biography in Bengali
সারা জীবন আনন্দের সহিত যে বাঁচবে সেই হল জীবনানন্দ। কিন্তু মানুষটা সারাজীবন কেঁদেই গেছেন। শোক তাঁর পিছু ছাড়েনি। তাঁর লেখা সাহিত্যের পাতায় উঠে এসেছে সেই অতৃপ্তি, সেই ক্ষোভ, দুঃখ। আর এই মানুষটি কে জানেন জীবনানন্দ দাশ (Jibanananda Das) । রইল তাঁর জীবনকাহিনী।
কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনী (Jibanananda Das Biography in Bengali)
জন্ম | ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ |
জন্মস্থান | বরিশাল (বর্তমান বাংলাদেশ)। |
পিতা ও মাতা | সত্যানন্দ দাশ ও কুসুমকুমারী দেবী। |
পেশা | কবি ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, গীতিকার, সম্পাদক, অধ্যাপক। |
দাম্পত্য সঙ্গী | লাবণ্য গুপ্ত । |
পুরস্কার | রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫২) সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার (১৯৫৫) । |
মৃত্যু | ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ (বয়স ৫৫)। |
জন্ম
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বরিশালে কবি জীবনানন্দ দাশ (Jibanananda Das) জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা ও মাতা
সত্যানন্দ দাশ এবং কুসুমকুমারী দেবীর তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম ছিলেন জীবনানন্দ। জীবনানন্দের পরে জন্মগ্রহণ করেন অশোকানন্দ দাশ এবং কন্যা সুচরিতা দাশ। জীবনানন্দ দাশের মাও কিন্তু একজন সাহিত্যিক। তাঁর লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা, "আমাদের দেশে হবে, সেই ছেলে কবে/কোথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে"।
মায়ের কবিতা লেখা প্রসঙ্গে জীবনানন্দ বলেছেন, ‘কি রকম তাড়াতাড়ি লিখতে পারতেন তিনি। রান্না করছেন, রান্না করছেন, পিসেমশায় আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন, এক্ষুণি ‘ব্রহ্মবাদী’র ফর্মা প্রেসে যাচ্ছে, অবিলম্বেই একটি কবিতা লিখে দাও কুসুম। অমনি মা খাতাণ্ডকলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একহাতে খুন্তি আর একহাতে
কলম নাড়ছেন। দেখা যেত- যেন চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছে না কোথাও! আচার্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখুনি কবিতা দিয়ে দিতেন।মা’র কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুণ মা যদি নিজের তখনকার জীবনের কবিতা লেখার বিশিষ্ট ঐতিহ্য অত তাড়াতাড়ি নিরস্ত না ক’রে ফেলতেন, তা হ’লে অনেক কিছুই হতে পারতো।
যে সাহিত্যিক ও কবির গরিমা তার প্রাপ্য ছিল, সেটাকে অন্তর্দমিত করে রাখলেন। তিনি প্রকাশ্যে কোনো পুরস্কার নিতেন না।’ পিতা সত্যানন্দ ছিলেন স্কুলশিক্ষক, প্রবন্ধকার, সমাজসেবক ও ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারক। বি এ পাশ করেন। এরপরই শিক্ষকতায় যোগ দেন। টাকা রোজগারের অনেক পথ তাঁর সামনে খোলা ছিল, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন কম
মাইনের শিক্ষকতাকে। ব্রজমোহন স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক তিনি। ‘ব্রহ্মবাদী’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, এখানে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। বাবা নিজে শিক্ষক হলেও, নানান কাজে ব্যস্ত থাকতেন তিনি। আর তাই মা কুসুমকুমারীর কাছেই জীবনানন্দ সহ তাঁর আরও ভাই-বোন পড়াশোনা করতেন।
কুসুমকুমারীর উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, পিবি শেলি, রবার্ট ব্রাউনিং-এর মতো ইংরেজ কবিদের কবিতা , বৈষ্ণব পদাবলী কিংবা হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব মুখস্থ ছিল। তাঁদের পৈতৃক পদবী ছিল দাশগুপ্ত। জীবনানন্দের পিতা গুপ্ত টা বাদ দিয়ে শুধু দাশ রাখেন।
ছাত্রজীবন
ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বেশ মেধাবী। খুবই বই পড়তেন। জীবনানন্দের ছাত্রজীবন শুরু হয় বরিশালের ব্রজমোহন স্কুলে। এই স্কুল থেকে ১৯১৫ তে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর ১৯১৭ সালে ব্রজমোহন কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। পাশ করার পর ভর্তি হন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে।
এই কলেজ থেকে ইংরেজিতে বি এ পাস করেন । এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করে, আইনের পাঠ শেষ করেন।
কর্মজীবন
পড়াশোনা শেষ করে ১৯২২ সালে কলকাতার সিটি কলেজে অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। ১৯২৮ কিংবা ১৯২৯-এ সেখান থেকে তাঁর চাকরি যায়। ১৯২৮ সালে সরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে কলেজে বিক্ষোভ হয়, সেই সময় কলেজ থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রী চলে যায়।
কলেজ আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে। আর তাই কলেজের প্রত্যেক বিভাগ থেকে কর্মী ছাটাই হয়। ইংরেজি বিভাগ থেকে জীবনানন্দের চাকরি চলে যায়। ১৯২৯ এ কলকাতা কলেজ থেকে খুলনা চলে যান। এরপর খুলনা রাজারহাট কলেজে মাত্র ৩ মাসের জন্য অধ্যাপনা করেন।
এরপর এই বছরের ডিসেম্বরএ দিল্লির রামযস কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৩৫ সালে বরিশালের বি এম কলেজে অধ্যাপনা করেন। দেশভাগের সময় চলে আসেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে তিনি কর্মহীন। এরপর ১৯৫০ এ খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনার কাজ করেন।
স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য চাকরি ছাড়তে হয়। এরপর যোগ দেন বড়িশা কলেজে, এরপর হাওড়া গার্লস কলেজে তিনি পড়ান।
দাম্পত্য জীবন
১৯৩০ সালের মে মাসে ঢাকার লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। ১৯৩১ এ তাদের কন্যা মঞ্জুশ্রী জন্মগ্রহণ করেন।
সাহিত্য কর্ম
১৯১৯ সালে প্রথম প্রকাশিত কবিতা "বর্য আবাহন"। এরপর ১৯২৭ সালে প্রকাশ পায়, তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "ঝরাপালক" । পর পর প্রকাশ পায় আরও কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। যেমন-
- "ধূসর পান্ডুলিপি" (১৯৩৬)।
- "বনলতা সেন" (১৯৪২)।
- "মহাপৃথিবি" (১৯৪৪)।
- "সাতটি তারার তিমির"(১৯৪৮)।
- মৃত্যু পরবর্তী প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ-
- "রূপসী বাংলা"” (১৯৫৭) ।
- "বেলা অবেলা কালবেলা" (১৯৬১)।
- "কবিতার কথা"(১৯৫৫) ।
শুধু কাব্যগ্রন্থ নয়, লিখেছেন উপন্যাস। যেমন - "মাল্যবান ও সুতির্থ"।
তাঁর কাব্যে প্রকৃতি এসেছে সুন্দর ভাবে। একেবারে যেন বাস্তব প্রকৃতি। প্রকৃতি প্রেমী একজন কবি। শুধু প্রকৃতি নয়, তাঁর কাব্যে এসেছে নারী। কখনো শাশ্বতী, কখনো সুরঞ্জনা আবার কখনো বনলতা সেন। কী অভাবনীয় সেই সব লাইন। যা আজও মনে দাগ কেটে যায়।
প্রকৃতির অভাবনীয় সুন্দর যার কাব্যে প্রস্ফুটিত, সেই মানুষটিকে সকলেই আখ্যা দিয়েছেন ‘রূপসী বাংলার কবি’ হিসেবে। তিনি মোট ২১ টি উপন্যাস এবং ১২৬ টি ছোটোগল্প লিখেছেন। কিন্তু একটাও প্রকাশ করে যেতে পারেননি।
পুরস্কার ও সম্মাননা
মৃত্যুর পরে ভারত সরকার তাঁকে ' সাহিত্য অ্যাকাডেমি' পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন।
মৃত্যু
১৯৫৪ খ্রীঃ ১৪ ই অক্টোবর অন্যমনস্ক এবং গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। ট্রামের ঘন্টাও তাঁর কানে পৌঁছায়নি। ব্যাস তারপর কেটে, ছিঁড়ে, থেঁতলে গ্যাছে সব জায়গায়। হাড় চুরমার হয়েছে। সবাই জল দিলেন, কেউ বাতাস দিলেন, কেউ দোকান থেকে বরফ এনে দিলেন।
এরপর সকলে ধরে ধরে ট্যাক্সি তে ওঠালেন। হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। ২২ শে অক্টোবর সকাল থেকে কথা বন্ধ, খাওয়া বন্ধ, তখন বাজে ১১ টা ৩৫। সবশেষ হয়ে গেল। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ২২ অক্টোবর কলকাতায় ট্রামের ধাক্কায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জীবনানন্দ।
উল্লেখযোগ্য তথ্য
- জীবনানন্দের বাড়ি প্রসঙ্গে জীবনান্দের ছাত্র আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, "বাংলো ধরণের বাড়ি-উপরে শনের চাল। বেড়া আধেক ইট আর আধেক বাঁশের।কিন্তু ভিতরে সাহিত্য-পাঠকের কাছে আশ্চর্য এক জগৎ। বই আর বই।"
- জীবনানন্দ ফুলশয্যার রাতে স্ত্রীর কাছে থেকে গানের আবদার জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ফুলশয্যার রাতে তার সর্বপ্রথম কথা হলো- ‘আমি শুনেছি তুমি গাইতে পার। একটা গান শোনাবে?’
- কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে 'ঝরাপালক' নামক একটি সিনেমা।
- জীবনানন্দ যেদিন মারা যান, তার কয়েক দিন আগে থেকে তিনি হাসপাতালে আসা পুরো বন্ধ করে দেন এবং মৃত্যুর সময়ে লাবণ্য দাশকে হাসপাতালে আনার জন্য দুবার গাড়ি পাঠানো হলেও তিনি আসেননি।
- জীবনানন্দ দাশের প্রথম জীবনের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি খোয়া গিয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে মঞ্জুশ্রী দেবী। যত দূর মনে পড়ছে, তিনি মেচেদা থেকে লোকাল ট্রেনে ফিরছিলেন। ট্রেনের বসার সিটের তলায় রাখা সুটকেসেই জীবনানন্দের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছিল। অনেক খাতা ছিল। যখন হাওড়া স্টেশনে নামেন, তখন দেখেন ওই সুটকেসটি নেই। সুটকেসচোর ভেবেছিল গয়না বা টাকাপয়সা আছে। কিন্তু সে সব কিছু না পেয়ে রদ্দি কাগজ হিসেবে বেচে দিয়েছিল। আর এই কাগজে মুদির দোকানদার ঠোঙা করে সর্ষে বিক্রি করেছেন । তবে হারানো পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ উদ্ধার করা গিয়েছিল। পুরোটা পাওয়া যায়নি!
- জীবনানন্দের এক খুড়তুতো বোন ছিলেন। তাঁর প্রতি দুর্বল ছিলেন উনি। কিন্তু সম্পর্ক গড়ার সাহস পাননি। তাঁর ছায়াতেই তিনি বনলতা সেন লিখেছিলেন।
- জীবনানন্দকে অনেক নামে আখ্যায়িত করা হত। যেমন- চিত্ররূপময় কবি, ধূসরতার কবি, তিমির হননের কবি, নির্জনতম কবি, রূপসী বাংলার কবি, প্রকৃতির কবি, বিপন্ন মানবতার নীলকন্ঠ কবি, বিপন্ন বিস্ময়ের কবি, পরাবাস্তববাদী কবি, শুদ্ধতম কবি, মৃত্যুচেতনার কবি, ইতিহাস চেতনার কবি, সময় চেতনার কবি, কাল চেতনার কবি, জীবন বোধের কবি।
কবি জীবনানন্দ দাশের জীবনী (প্রশ্নোত্তর) - Jibanananda Das Biography in Bengali (FAQ)
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থ কোনটি?
ঝরা পালক (১৯২৭).
জীবনানন্দ দাশের ছদ্মনাম কি?
'শ্রী', 'কালপুরুষ'।
জীবনানন্দ দাশের জন্ম কবে এবং কোথায়?
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের বরিশালে কবি জীবনানন্দ দাশ জন্মগ্রহণ করেন।
জীবনানন্দ দাশের পিতা ও মাতার নাম কী?
সত্যানন্দ দাশ ও কুসুমকুমারী দেবী।
জীবনানন্দের স্ত্রীর নাম কী?
লাবণ্য দাশ।
জীবনানন্দ দাশ কত সালে মারা যান?
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ২২ অক্টোবর।
শেষ কথা
এতক্ষণ পড়ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ জীবনী (Jibanananda Das)। তাঁর জীবনের ইতিহাস পড়ে আপনার কেমন লাগলো কমেন্টে জানাতে ভুলবেন না। আপনি আমাদের সাইট BongHood.Com এর মাধ্যমে আরও অনেক মহান ব্যাক্তি ও মনিষীদের জীবনী পড়তে পারেন। আপনার মহামূল্যবান সময়ের কিছু অংশ থেকে সময় বার করে আমাদের এই প্রতিবেদন টি পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই। ভালো থাকবেন।
পিডিএফ ডাউনলোড, অন্যান্য সাহায্য অথবা অনুরোধ জানানোর জন্য সরাসরি যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে।
Conclusion kothay a6e